পুজোর গল্প ৩ | নাটকীয় নাটক

আমার বেশ দুর্নাম আছে। বাড়িতে, অফিসেও। কিরকম? আমাকে খুব প্রশংসা করলেও আপনাকে বলতেই হবে আমি বেশ ‘অ’সুর। মানে গানের ব্যাপারে।

আমার সঙ্গে ২৪ ঘন্টা যে মানবী থাকেন, তার এই নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। মানে আগে, বিয়ের শুরুতে ছিল অনুযোগ। বিবাহের ৯ বছর পর, সেটা অভিযোগে পরিণত হয়েছে। একেই মনে হয় ইভোলুশন বলে।

জাগ্গে, ইনিয়ে-মিনিয়ে কাজ নেই। প্রতিপাদ্য বিষয় হইলো যাহা আমার মধ্যে কালচার ব্যাপারটা ভালচারে (vulture) খেয়ে গেছে ছোটবেলাতেই।

এবং ঠিকই ধরেছেন। এর সাথেও দুগ্গা পুজোর সম্পর্ক আছে। এবং এটাও সেই নিউ আলিপুরের সাহাপুরের হাউসিং কেন্দ্রীক।

ছোটবেলায় পুজোর মাস দুয়েক থেকেই জোর কদমে শুরু হয়ে যেত পুজোর চারদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক – একেবারে জমজমাট ব্যাপার।
খুব উৎসাহ নিয়ে বাবা-মা’রা এতে অংশগ্রহণ করতেন, আমাদেরও উৎসাহ দিতেন।

তো এই চারদিন প্রধানত বয়োজ্যেষ্ঠরা, দাদারা, দিদিরা এবং আমাদের সমবয়সী মেয়েরা আয়োজন আর অংশগ্রহণ করত। আমরা ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়েই মেতে থাকতাম, আর অবশ্যই পুজোর প্যান্ডেল সাজানো নিয়ে।

ঠেলা মারলেও আমাদের মধ্যে কেউই ওই গান, আবৃত্তি আর নাটকের দিকে পা বাড়াতোনা।
কিন্তু ওই যে বলেছি সময় ও বয়সটাই ছিল বেশ গোলমেলে।
সবে তখন দাদার কীর্তি আর বসন্ত বিলাপ দেখে মনটা বেশ উড়ু উড়ু করছে।

এই দুগ্গাপুজোয় কাদের অনুষ্ঠান বেশি বাহবা পায় তাই নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে একটা হালকা কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল।

বিপত্তি যদিও ছিল অন্য জায়গায়।
গান কেউই গাইতে পারেনা।
আবৃত্তি সেই ছোটোবেলায় স্কুলে ‘নমস্কার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ’ অবধিই দৌড় ছিল। তাহলে যেখানে মেয়েরা গান-নাচ-আবৃত্তি সবকিছুই করতে পারছে, সেখানে আমাদের অবস্থা শোচনীয়।

অষ্টমীর রাত্রিতে আমাদের দেয়া হলো ১ ঘন্টার সময়। অনেক চেষ্টা করেও আয়োজক দাদা এবং দিদিরা কিছুতেই বার করতে পারলো না যে আমরা ঠিক কি করবো। তাই অনুষ্ঠান সূচীতে লেখা রইলো “সারপ্রাইস”।

সপ্তমীর রাত অবধি দুগ্গা ঠাকুরের সামনে বসে জোর আলোচনা চললো আমাদের যে কি করা যায়। বোধহয় মা দুগ্গারও কপালে ভাজ পড়েছিল যে এরা ঠিক কি করে উঠবে। আলোচনা শেষে ঠিক হলো আমরা নাটক করবো।

সময়ই বলতে পারত যে এটা সারপ্রাইস থেকে ডিজাস্টার হতে চলেছে। কিন্তু কিছু একটা তো করতেই হবে। তাই ভেসে চলো। কোথাও ঠিক পৌঁছে যাব।

কিন্তু এবার প্রশ্ন কি নাটক? অনেক সাজেশন এলো। পাগলা দাশুর মিনি সংস্করণ থেকে এদিক ওদিক যা পাওয়া যায়, অধিকাংশই আজ মনে আর পড়ছেনা।

যাই নাম উঠলো কোনোটাই ৫-৬ ঘণ্টায় মঞ্চস্থ করা যায় না। বেলা বারোটায় শেষে বড়রা এসে ultimatum দিলেন। ঠিক করো কি করবে নইলে ওই সময় অন্য কাউকে দেয়া হবে। বাঙালী অনেক কিছুই খেতে ভালোবাসে। কিন্তু বেশি ভালো লাগে “বার” খেতে। সেই ইয়েতে আমাদের মধ্যে একজন বলে বসলো যে নাটক করবো আর আমরা তৈরি। শুনে মাথা নেড়ে ওনারা চলে গেলেন বটেক কিন্তু অভিব্যক্তি দেখে খুব যে আশাবাদী মনে হলোনা।

পরের ৩ ঘন্টায় যা হলো প্রস্তুতি বলে তাকে স্পেস-টাইম থিওরিতে ফেললে হয়তো একটা নোবেল পুরস্কার পাওয়া যেত। আচ্ছা, নিদেনপক্ষে ভারতরত্ন।

দশজন ছেলে মিলে চূড়ান্ত রকমের অঘটনের মধ্যে কোনো এক বিখ্যাত নাটকের খান কুড়ি লাইন কপি করে একখান স্ব-কপিড নাটকের নামে কিছু একটা দাড় করালো।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্তিত হলো। অষ্টমীর সেই সন্ধ্যে মনে আছে। সুন্দর মৃদুমন্দ হাওয়া। অক্টোবর মাসের শেষে শীত হালকা teaser দিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েদের নাচের অনুষ্ঠান শেষ। দর্শকরা বেশ উপভোগ করেছে।

তারপর মাইকে বলা হলো – “আমাদের ছোট ছেলেরা এবার নাটক পরিবেশন করবে। নাটকের নাম হলো…”। সব চুপ। নাটকের নামই তো ঠিক হয়নি। তাই অগত্যা আমরা বীর বিক্রমে নেমে পড়লাম স্টেজে।

আমরা প্র্যাক্টিসে ২০ মিনিট টেনে ছিলাম। যেটা হলো সাড়ে তিন মিনিটেই ডায়লগ শেষ। কিরকম? আমাদের এক বন্ধু বেশ “highly placed”, মানে বেশ লম্বা। শুরুতেই স্টেজে তার একটি ঝড়ের বেগে আবির্ভাব ছিল। বাস্তবে যা ঘটলো, বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে সে এক বিশাল লাফ দিয়ে প্রবেশ করলো বটে। কিন্তু সেই লাফে ধরাশায়ী হলো স্টেজে উপস্তিত আমাদের অন্য বন্ধুটি।

বাকিরা মঞ্চের বাইরে থেকে গতিক সুবিধের নয় বুঝে, sequentially মঞ্চে উঠে যে যার ডায়ালগ মুখস্থ বলে গেল। তার মধ্যে এক অত্যুৎসাহি বন্ধু অন্যজনের ডায়লগ বলে দেওয়াতে সেখানে আরো গোলমাল হয়ে গেল।

মঞ্চে তখন নয়জন মিলে হুলস্থুল কান্ড।

আর যার শেষে আসার কথা ছিল, সে মঞ্চে উঠে হাঁ করে চেয়ে রইলো। এই সাড়ে তিন মিনিটে স্টেজের লাইটম্যান কি আলো ফেলবে বুঝতে পারলোনা। সাইড থেকে এক দাদা অবস্থা বুঝে যবনিকা পতন ঘটিয়ে দিলো। পর্দা পড়ে গেল। পর্দার পেছনে তখন আমরা দশ জন তুমুল হট্টগোল করছি।

হয়তো এরকম চলতো যদি না বাকি সবাই এসে আমাদের নামিয়ে না দিত। চুপচাপ আমরা সরে গেলাম। বাকি পুজোতে আমাদের সবাইকে বাকিরা আর সেভাবে খুঁজে পায়নি।

আর যাদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে এই দুরবস্থা হলো, তাদের সাথে সন্ধি স্থাপনই সমীচীন মনে হলো।

তবে সেই শুরু, সেই শেষ। আর কোনোদিন এরকম এডভেঞ্চার করিনি কালচার নিয়ে।

রইলো বাকি গান। যে বা যারা শুনেছে, বা আজও বিপদে পড়ে শোনে, সেই কথা তোলা থাক আরেকদিনের জন্যে।

পুনশ্চঃ আমার ছোট্ট হনুমানটি যদিও আমার সাথে বেশ গান গায়। সুবিধে হলো সে সুর ধরে নেয়। আমার চিন্তা তাতে একটু কমলো বৈকি।

ইতি,
সেই ছোট্ট হনুমানের বাবা।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s