সকালে ঘুম থেকে উঠে, আধো ঘুম চোখে, জানলার পর্দা হালকা সরিয়ে চোখে পড়লো যে আস্তে আস্তে চারিপাশের আলোকসজ্জা খুলে নেয়া হচ্ছে। পাড়ার লাউডস্পিকার নিশ্চুপ, যেন ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছে পাঁচ দিনের শেষে। সকালটা আজ বছরের অন্যদিনের মতো। সব যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে অথচ ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলেছে, সময় গড়িয়ে আসছে, বিদায়বেলার। দশ দিনের হইহুল্লোড় শেষে, আজ সে তার পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। আজ বিজয়া দশমী।

ছেলেবেলায় দশমী এলেই মন খারাপের প্রধান কারণ ছিল যে, আবার পড়ার বইখাতা নিয়ে বসতে হবে। কিন্তু সে আমি যেন সেই শ্যামাপোকা, শেষের আগে, আগুনের কাছে শেষবারের মতো গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো। তাই সে চলে যাবে, কিন্তু আমরা তাকে বিদায় জানাবো আমাদের মতো করে, নাচে-গানে মাতিয়ে।

বড়রা মা দুগ্গাকে বরণ করে, কানে কানে বলে রাখবে আবার এস। জলের পাত্রে রাখা আরশির মাঝে আমরা বন্ধুরা ঠ্যালাঠ্যালি করে ঠিক খুঁজে পেতাম মায়ের মুখ। তারপর বই-খাতা-পেন্সিল বাক্স নিয়ে সবার পায়ে ঠেকিয়ে, মনে মনে বলি যে সারা বছর না পড়াশোনা করলেও, ঠাকুর পরীক্ষায় উতরে দিয়ো। সঙ্গে কুড়িয়ে আনতাম ঠাকুরের পায়ের ফুল আর বেলপাতা। বইয়ের প্রথম পাতায় থাকা সেই ফুল আর বেলপাতা কিছুদিনেই ফসিল হয়ে উঠবে, তাও ওতেই আছে দুরন্ত আত্মবিশ্বাস। সেই সঙ্গে প্যান্ডেলের আরেক প্রান্তে চলছে মেয়েদের সিঁদুর খেলা। লালচে আভায় মেতে উঠত চারিদিক।


একটু পরেই, বড় ট্রাক আসবে তাকে নিয়ে যেতে। জ্যাঠা-কাকু-দাদারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাকে নামিয়ে আনবে আর আমরা ছোটরা তার অস্ত্র নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকব। তারপর ঘাটে পৌঁছে, শুরু হয় ভাসান নাচ। এমন এক নেত্ত যার কোনো প্যাটার্ন নেই। সে নিয়ে এক আস্ত পিএচডি হতে পারে। আর সঙ্গে থাকে গগনচুম্বী আহ্বান – আসছে বছর আবার হবে।



সব শেষে, বাড়ি ফেরত এসে, পাড়ায় ফাঁকা প্যান্ডেলে বসে দিন গোনা হতো, আবার কবে হব বাধঁনছাড়া। আর সব বন্ধু মিলে প্লান করা হত এবাউট দা নেক্সট বিগ থিং – “বিজয়া করতে যাওয়া”।
“বিজয়া করা”, মানে পাড়ার জ্যাঠা-কাকাদের বাড়িতে ঢিপ করে প্রণাম ঠোকা আর অপেক্ষায় থাকা কখন ভেতর থেকে জ্যেঠিমা-কাকিমারা প্লেটে সাজিয়ে আনবে, বিজয়ার মিষ্টি আর নোনতা। কুচো নিমকি আর ঘুগনি ছিল ছোটবেলার বিজয়ার আইকন। আর থাকত হরেকরকমের মিষ্টি। আর আমাদের মতো হ্যাংলা পার্টির নেক্সট কাজ ছিলো, মনে মনে নোট করে রাখা যে কে ভালো খাওয়ালো। পরের বছর সেখানে প্রণাম আরো ভালো করে সারতে হবে। আজ সেই ছেলেবেলাও নেই, নেই সেই বিজয়া করার উন্মাদনা। ফোনে কিংবা whatsapp এ কিংবা ফেসবুকে কি আর সেই নিমকি আর ঘুগ্নির চেনা গন্ধ পাওয়া যায়?
তাই আজ রইলো হনুমানের তরফে শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা আমাদের সকল অনুরাগীদের জন্য। আর সঙ্গে থাকলো এভেরগ্রিন কুচো নিমকি আর ঘুগনি। ভুলে যাওয়া স্মৃতির চেনা গন্ধটা কি পাওয়া গেল?

পুনশ্চঃ নিমকি আর ঘুগনির ছবিটা পাঠিয়েছে সায়নী, সুদূর সুইটজারল্যান্ড থেকে।