করোনা ভাইরাসের চক্করে শহর কলকাতার আকাশ কিন্তু অনেক পরিষ্কার।
এখন ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচিরে।
অনেকটাই কল্পনার বাইরে। বিশ্বাসও হয়না।
তাই সময় পেলেই ছাদে পালাই।
আজ নীল আকাশে চোখে পড়ল কিছু ঘুড়ি উড়ছে।
লাল, নীল, সবুজ ঘুড়ি নীলাকাশকে বেশ রাঙিয়ে দিচ্ছে।
ঘুড়ি উড়িয়েছি তাও বেশ কিছু বছর হলো।
নিচে নেমে ঘরের ওপরের লফ্ট থেকে খুঁজে বার করলাম একটা আস্ত ঘুড়ি আর লাটাই। দেখে মনে হলো একটু হয়তো ওড়ানো যাবে। ছাদে ফিরে শুরু হলো অনেক পুরনো অভ্যেস জাগিয়ে তোলা।
ঘুড়ি উড়লো। লাটাই ছাড়লাম। আরো কিছুটা উড়ে গেল।
এদিক ওদিক থেকে অন্য ঘুড়ি জড়িয়ে পরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
লাটাই ছাড়তে ছাড়তে হঠাৎ কানে এলো অন্য একটা গলা।
– রাহুল লাটাই ছাড়রে! ধরে আছিস কেন?
– sure মালটা আবার অন্য কিছু ভাবছে। বুঝলি শুভজিৎ।
দ্বিতীয় গলাটা অনির্বানের। প্রথমটা শুভজিতের।
ছাদটা এখন কেমন জানি শুভজিতের ২৫০ বছর পুরানো তালতলার বাড়ির মতো লাগছে।
আমাদের মধ্যে শুভজিতেরই ঘুড়ি ওড়ানোর expertise আছে। তাই আমি আর অনির্বাণ হলাম আসিসটেন্ট। বেশ উড়লো ঘুড়িটা।
শুভজিৎ বেশ কেতায় কয়েকটাকে কাটলো।
– তোরা তিনে কি খাবি না? বেলা হয়ে গেল।
শুভজিতের মায়ের গলা নীচ থেকে।
শুভজিতের এই তালতলার বাড়িতে আসলে আমার বেশ লাগে। ফ্লাটবাড়িতে বড় হওয়া আমি, এই চওড়া সিঁড়ি, উঁচু সিলিং, কলেজে উঠে বড় ভাবা নিজেকে বেশ ছোট লাগে। খাবার টেবিলে পৌঁছে দেখলাম রয়েছে গোটা সিদ্ধ। বিশ্বকর্মা পুজো যে। আমায় যারা চেনে, তারা জানে শাকসবজি আর আমার একটা মারকাটারী সম্পর্ক। তাও পুজোর প্রসাদ বলে অল্প কিছু খেলাম।
ফের ছাদের চিলেকোঠার ঘরে শুয়ে আমরা গল্প করছি। গরম খুব নেই। হালকা হাওয়া আসছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে।
– কিরে রাহুল? ঘুড়ি ওড়াবি আবার?
শুভজিতের প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে। চুপ আমি।
– অনেক নাটক করেছিস। চল একটু চাইনিজ খেয়ে আসি।
তড়াক করে অনির্বান বলে উঠলো – এইতো খেলাম যে। আবার কি খাবো।
শুভজিতের স্বগোক্তি – মুখটা দেখ ছেলের।
দুই বন্ধু কিন্তু ঠিকই বোঝে আমায়।
বেরিয়ে পড়লাম। তালতলা থেকে পার্ক স্ট্রিট হেটেই আসা যায়।
সময় কিন্তু বছর আঠারো আগের। ওলা উবের নেই। মোবাইল সবে হাতে।
তাই তিন বন্ধুতে হাঁটা দিলাম। তালতলা থেকে একটু এগিয়ে বাঁ হাতে রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড ধরে সিধে পার্ক স্ট্রিট। টুং টুং করে ট্রাম আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। এই রাস্তাটা গাড়ি আর ট্রাম একসাথে চলে। পার্ক সার্কাস হয়ে এসপ্লেনড।
– আজকে তোদের খাসা জায়গায় নিয়ে যাবো চল।
শুভজিৎ বলে। আমাদের আইডিয়া খুব বেশি নেই, তাই যা বলে তাই সই।
হাটতে হাটতে একবারে পার্ক স্ট্রিটে আর এসপ্লেনডের দিকে মোড়ে পৌঁছানোর ঠিক আগে, ডান হাতে দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে Peiping Chinese restaurant।

হিসেব করে দেখলে সেই আমার প্রথম পার্ক স্ট্রিটে খাওয়া।
এই Peiping রেস্তরাঁ বেশ যাকে বলে “value for money”। আমরা কলেজে পড়ি তখন। হাত খরচা নেই বললেই চলে।
তাই এক প্লেট চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস, সঙ্গে Peiping এর ওয়ার্ল্ড ফেমাস চপসুই আর চিলি চিকেন।

দুই বন্ধু দেখলো আর হাসলো বেশি। হামলে পড়ে খেলাম আমি।
Peiping রেস্তরাঁ বেশ একটা পুরোনো দিনের আমেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের decor বললে পুরোটাই সাদায় মোড়া। হাসি মুখে waiter খাবার সার্ভ করছে। কিন্তু সব কিছুতেই যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
খাওয়া হলো, সঙ্গে আড্ডা।
হঠাৎ শুভজিৎ বলে – আমার একটু কাজ আছে। বালিগঞ্জের দিকে যাব।
খোলসা করে বলছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে কেস জন্ডিস। সিওর প্রেম করছে।
অগত্যা বাইরে বেরিয়ে আসি। সন্ধ্যা নেমে আসছে।
ঠান্ডা একটা হাওয়া তখনও দিচ্ছে।
আমরা হাঁটা দিলাম মল্লিকবাজারের দিকে।
হঠাৎ শুনলাম আবার কে ডাকছে?
– কিরে! কখন থেকে ডাকছি! লাটাই মাটিতে পড়ে কেন?
ভালো করে তাকিয়ে দেখি, একি কোথায় পার্ক স্ট্রিট আর Peiping।
শুভজিৎ আর অনির্বানই বা কোথায়।
সামনে দাঁড়িয়ে শাশ্বতী, আমার বেটার-হাঁফ।
কোথায় ২০০২। সেই তো আবার ২০২০। বুঝলাম বয়েস হয়েছে। ঘুড়ি নিয়ে চেষ্টা করতে করতে যে কখন ছাদের কোনায় বসে পড়ে, হারিয়ে গেছি, তার খোঁজ নেই।
Peiping রেস্তরাঁ খুলেছিল ১৯৫০ এর দিকে। পার্ক স্ট্রিটে ঢুকলেই চোখে পড়ত। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেড়ে, বন্ধ হয়ে পড়ে।
জীবন মানেই আল্টিমেটেলি Survival of the fittest।
কিন্তু অন্ধকার কাটবে, সকাল আসবে।।
করোনা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমরা আবার ইঁদুরদৌড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব।
তবে এবার কিন্তু সময় করে বন্ধুতে মিলে আবার যাবো।
সেই সব রেস্তোরায় যেখানে অনেক স্মৃতি আছে,
যারা এখনো অপেক্ষায় বসে আছে।
P.S:
1. The Chinese food image is not from Peiping, but from our Honuman kitchen. 🙂
2. Peiping restaurant photo courtesy, The Telegraph
3. Cover image of kite flying is taken from user “cocoparisienne-127419” under Pixabay Free Commercial use license.