পুজোর গল্প ১| পুজো প্যান্ডেল আর ছেলেবেলা

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মূল ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। একান্ত মালিকানা ছবির স্রষ্টার। আমরা কেবলমাত্র গদ্যের জন্যে ব্যবহার করেছি।

আমার বড় হওয়ার অনেকটা অংশ জুড়ে আছে কলকাতা শহরের নিউ আলিপুরের এক হাউসিং।
সেই ১৯৯১ থেকে। তখন ক্লাস ১ এ পড়ি।
এই আগস্ট মাস এলেই যেন মনের কোথাও উঁকি দিত একটাই প্রশ্ন – আর কদিন বাকিরে পুজো আসতে?
সবার প্রথমে হতো বেহালার শীলপাড়ায় ঠাকুরের বায়না দিতে যাওয়া।
প্রতি বছর আমরা ছোটরা হৈচৈ তুলতাম কুমারটুলি থেকে ঠাকুর আনা হোক। আর বাবা-কাকা-জ্যাঠারা কিছুতেই রাজি হতেন না। অগত্যা সেই শীলপাড়া থেকেই সই।

আসল উৎসাহ ছিল কিন্তু অন্য জায়গায়। আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনেই ছিল মাঠ, যেখানে প্যান্ডেল বাঁধা হতো। তার মানে চাইলে, সারাদিন বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়া যেত সব দিন – পুজোর মাস খানেকের ও আগে থেকে সেই কালীপূজা অবধি।

কিন্তু চাইলেই বা পাওয়া যেত কি! রয়েছে স্কুল।আমার বাকি বন্ধুরা সবার ছিল মর্নিং স্কুল। আর আমার আফটারনুন।
যেদিন প্রথম দিন প্যান্ডেলের বাঁশ এসে পরতো আমাদের মাঠে, সেদিন আমাদের দেখে আর কে?
সারা সন্ধে স্তূপাকৃত বাঁশের পাশে বন্ধুরা ভাবনা-চিন্তা করছি যে কত উঁচু প্যান্ডেল হবে।
ছেলেবেলার কল্পনার ঘোড়া সাঁইসাঁই করে ছুটছে।
একবার বন্ধু সানি বললো “দেখ এবারতো শুনেছি ৯ ফুটের দুর্গা প্রতিমা। তাহলে ভাব কত উঁচু প্যান্ডেল হবে।” রকির কথা অবশ্য আমাদের ফিরিয়ে আনত বাস্তবের মাটিতে – “প্রতিবারই বলা হয়, কিছুই হয়না”।

তবু আমাদের আশা হার মানেনা।
রাত্রি নেমে আসছে, ওদিকে চারিদিকের ফ্লাট বাড়ি থেকে আমাদের মা-কাকিমা-জ্যেঠিমারা হাঁক পারতে লাগলো বাড়ি ফেরার জন্য। সবাই চলে গেলাম যে যার বাড়ির দিকে।

পরের দিন যে আসল খেলা।প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হবে।
আমার আফটারনুন স্কুল বলে আমি ফিরতাম সবার পরে। তত্ক্ষনে কে জানে কতটা প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেল।
স্কুলের ক্লাসে মন কিছুতেই বসত না। কোনোমতে ছুটির ঘন্টা শেষে স্কুল বাসে করে এক ছুটে মাঠে পৌছতাম।
হাঁপ ধরে গেলেও মন শান্ত হতো যে, যাক বেশিদূর কিছু হয়নি – একতলা বাঁধা হয়েছে খালি।

স্কুল ব্যাগ মাটিতে রেখে সেই প্যান্ডেলের বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠা। কে কত আগে উঠতে পারে।
এই ভাবেই প্রতি সন্ধেবেলা চলতো আমাদের আর প্যান্ডেলের খেলা।
কিছু কিছু দিন যখন বৃষ্টি নামতো, সকালে উঠে অথবা বিকেলে স্কুল ঠেকে ফিরে ঠিক সেই চেনা গন্ধটা পেতাম। ভেজা বাঁশের সাথে সময়ের এক অদ্ভুত চেনা স্মৃতি।

তখন প্যান্ডেলটা যেন খালি কোনো অপার্থিব বস্তু নয়, আমাদেরই খেলার বন্ধু।
মা আসার আগে এসেছে সব ব্যবস্থা করে নিতে।
এরপর আসতো পুজো। সে গল্প থাক আরেকদিনের জন্যে।

ফিরে তাকালে আজ মনে পরে, সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছি যখন প্যান্ডেল খুলে ফেলা হতো।
মায়ের বিসর্জনের পরেও ওই কিছু দিনের জন্য পড়ে থাকা প্যান্ডেল ছিল আমাদের পুজোর শেষ স্মৃতি।
তারপর আর সকালে উঠে দেখতে পেতাম না, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেও থাকত পরে সেই খালি মাঠ।
আবার অপেক্ষা সেই আগস্ট মাসের জন্য।

আজ লিখতে বসে বারবার মনে হচ্ছে আমাদের ছোট্ট হনুমানেরা কি পাবে সেই সব চেনা ছবি, চেনা গন্ধ? নাকি তাদের কাছে সবই থাকবে অচেনা।

কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই বদলেছে, রেখে গেছে কিছু ছবি, মনের কাছে।

ইতি,সেই ছোট্ট হনুমানের বাবা।

পুজোর গল্প সিরিজে দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন – পুজোর গল্প ২ | বাড়ি থেকে পালিয়ে

5 thoughts on “পুজোর গল্প ১| পুজো প্যান্ডেল আর ছেলেবেলা

    1. অনেক ধন্যবাদ। ইচ্ছে আছে এরকম হারিয়ে যাওয়া পুজো নিয়ে আরো কিছু গল্প আনার। সঙ্গে থাকবেন।

      Liked by 1 person

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s